সাবাবার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা

একাদশ শ্রেণিতে অ্যাপ্লাই করেছিলেন আমেরিকার ৫০টি কলেজে৷ রিজেকশন এসেছিল ৪৬টা। হাতে গোনা যে ৪টা অ্যাক্সেপটেন্স এসেছিল, তা অ্যাফোর্ডেবল না৷ ভেঙে পড়েন তিনি। কিন্তু পরের বছর ফিরে আসেন দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে। নতুনভাবে অ্যাপ্লাই করেন ১০০টি কলেজে। এবার ফুল রাইড স্কলারশিপে সুযোগ হয়ে যায় কানেক্টিকাট কলেজে। তিনি রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী (বাংলা মিডিয়াম, এইচএসসি-২০২২) সাবাবা আহমেদ, ডিপি টিউটোরিয়ালসের ডিরেক্টর অফ মার্কেটিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরিত্র আহমেদ, ডিপি টিউটোরিয়ালসের একজন কন্টেন্ট রাইটার।

অরিত্র : জীবনে প্রথম কখন ও কীভাবে মনে হলো যে একদিন বিদেশে পড়তে যাব?

সাবাবা : আমার এক খালু আছেন, যিনি ইংল্যান্ডের একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে যান। মূলত খালুর কাজ দেখেই সেখান থেকেই বিদেশে পড়তে যাওয়ার স্বপ্নটা শুরু হয়, কিন্তু মাস্টার্স অথবা পিএইচডির জন্য। জানতাম না, আন্ডারগ্র্যাডেও বিদেশে পড়তে যাওয়া যায়। জাওয়াদ চৌধুরী নামের একটা ভাইয়ার সম্পর্কে পড়েছিলাম পত্রিকাতে, যিনি এমআইটিতে চান্স পেয়েছেন এবং ম্যাথ অলিম্পিয়াডে গোল্ড মেডালিস্ট। তখন মনে হলো– যারা অলিম্পিয়াডে এরকম মেডালিস্ট, তাদেরকে হয়তো ইউনিভার্সিটিগুলো ডেকে নিয়ে যায়। এমআইটি-ও সেটাই করেছে। তাই আমি নিজেকে ওভাবেই প্রস্তুত করছিলাম যেন আমি বুয়েটে চান্স পাই এবং সেখান থেকে পরে মাস্টার্স করতে বাইরে যেতে পারি।

এসএসসির পর করোনার সময়ে হাতে কোনো কাজ ছিল না। অনলাইনে কাজ খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে জয়েন করি RYC Global নামে দীপ্র ভাইয়ার যে নন-প্রোফিট অর্গানাইজেশনটা ছিল, সেখানে। এসময়ই জানতে পারি যে অলিম্পিয়াড মেডেল এবং টাকা ছাড়াও বাইরে পড়তে যাওয়া যায়। তখন আমি এই বিষয়গুলো ঘাটতে শুরু করি। এরপর ২০২১ সালের প্রথমদিকে এসএটি ব্যাচ, কলেজ অ্যাপ্লিকেশন কো-হর্টের আয়োজন করেন দীপ্র ভাইয়া। এখানেই শুরু হয় আমার কলেজ অ্যাপ্লিকেশন জার্নি। ঠিক করে ফেলি, আন্ডারগ্র্যাড করতে আমাকে আমেরিকাতেই যেতে হবে।

অরিত্র : ফ্যামিলির সবার দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত কেমন ছিল? কোনো বাধা পেয়েছেন?

সাবাবা : প্রথমবার (Fall-2022) অ্যাপ্লাই করার সময়ে অনেক কিছু ফেইস করতে হয়, কারণ আমার প্যারেন্টস-সহ আশে-পাশের কেউই জানতেন না যে আন্ডারগ্র্যাডেও অ্যাপ্লাই করা যায় এবং কীভাবে যায়। এছাড়াও যেহেতু আমি আমার কলেজের জন্য বাবা-মা থেকে দূরে ছিলাম, তাই আমি আসলে রাতে কী করছিলাম এটার ব্যাপারে তারা সন্দিহান ছিলো। বাইরের অনেক মানুষের অনেক কথায় ইনফ্লুয়েন্সড হচ্ছিলেন বাবা-মা। মাঝখানে এরকম একটা সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল যে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে পাঠানো হবে ; একা গেলে আমি স্পয়েলড হয়ে যেতে পারি। কিন্তু দ্বিতীয়বার (Fall-2023) অ্যাপ্লাই করার সময়ে অনেক সাপোর্টিভ ছিলেন বাবা-মা। দেশের কোথাও ভর্তি পরীক্ষা না দেওয়ার ব্যাপারটিকেও তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন।

অরিত্র : ইংলিশে দক্ষতা অর্জন করেন কীভাবে?

সাবাবা : ইংলিশে দক্ষতা অর্জনে RYC Global অনেক হেল্প করে আমাকে। ইন্টারন্যাশনাল অনেক মেম্বার ছিল ওখানে, কথা বলতে গেলে ইংলিশে বলতে হতো।

অরিত্র : ইসিএ ডেভেলপ করার জার্নিটা নিয়ে বিস্তারিত শুনতে চাই।

সাবাবা : স্বরবর্ণ শেখার আগেই আমি গান শিখেছিলাম। ৪ বছর বয়সে বাবা আমাকে হারমোনিয়াম গিফট করেছিলেন। পরবর্তী ৭ বছর গান শিখি। বাবার কাছে শিখতাম কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়। সেখান থেকেই স্কুলের ছোট ছোট কম্পিটিশনগুলোতে পার্টিসিপেট শুরু করলাম। এভাবেই দেখা গেছে গানের প্রতিযোগিতাগুলোতেই অংশ নিতে নিতে অন্যান্য ইসিএ-র ব্যাপারে জানতে পারি এবং সেসব ফিল্ড এক্সপ্লোর করা শুরু করি। এরপর ক্লাস ফোরে থাকতে মৌসুমী বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সারা বাংলাদেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় আমাদের স্কুল। সেখান থেকে ইচ্ছা হলো, আমি ডিবেটেও জয়েন করব। তারপর বিতর্ক করতে গিয়ে এটার উপর একটা ভালোবাসা চলে আসে। আসলে সবকিছুর প্রতিই কৌতূহল কাজ করত বলে সব ধরনের কাজই করা হয়েছে, আর আমার সব কাজ করতেই ভালো লাগতো।

এভাবেই চলছিল। এসএসসির ভ্যাকেশনের সময়ে লকডাউন চলে আসায় এক বা দুইমাসের জন্য সবকিছু একদম স্টপ হয়ে যায়। কিন্তু সবসময় পড়াশোনা এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে আমার। তখন আমার স্কুলেরই এক সিনিয়র আপু অ্যাপ্রোচ করে একটি কম্পিটিশনের খোঁজ দেন, জানান তিনি একজন ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর। সেখান থেকেই এই টার্মটার সাথে পরিচিত হই। নন-প্রোফিট অর্গানাইজেশন ‘প্রত্যুষ’ ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর নিচ্ছিল, সেই কম্পিটিশনে স্পেশাল মেনশন অ্যাডওয়ার্ড পেয়ে ওদের মূল টিমে জয়েন করি। বিভিন্ন ধরনের প্রোজেক্ট করছিল ওরা, সেখানে হেল্প করতাম। কিছুদিন পর RYC Global-এও জয়েন করি। দীপ্র ভাইয়াসহ অন্যরা অনেক কম্পিটিশনের কথা বলত, সেগুলোতে জয়েন করতাম।

অরিত্র : এত ধরনের ইসিএ থেকে কমন অ্যাপ অ্যাক্টিভিটি সেকশনে দশটার মধ্যে কতগুলো ঘর পূরণ করেছিলেন এবং আপনার কোন কাজগুলো উল্লেখ করেছিলেন?

সাবাবা : আমি দশটাই ফিল আপ করেছিলাম। সত্যি বলতে, কোন দশটা দেবো– তা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার ডিবেটিং, ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় রোবটিক্স ক্যাম্পেইন, RYC Global-এর অভিজ্ঞতা, স্টকহোম ওয়াটারপ্রাইজের স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর হওয়া, আরেকটা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা, হ্যান্ড অ্যান্ড ক্র্যাফটের ওপর আমার একটা ছোট বিজনেসের কথা, স্কুলের ই-ম্যাগাজিনের কো-ফাউন্ডার হওয়া, স্কাউটিং, এবং থিয়েটারের কথা লিখেছিলাম।

অরিত্র : ইসিএ বাদে অ্যাপ্লিকেশনের অন্য অংশগুলো– রেকমেন্ডেশন লেটার যোগাড় করা এবং বিভিন্ন অ্যাসে লেখাটা কীভাবে হ্যান্ডেল করেছিলেন?

সাবাবা : তখনো অনলাইনে ক্লাস করার কারণে টিচাররা আমাকে তেমন চিনতেন না। প্রথমবার অ্যাপ্লাই করার সময় কলেজের সিনিয়র আমিরুল ইসলাম শুভ ভাইয়া, নওশিন আনবার আপু, মেহেদি হাসান সিজার ভাইয়া আর স্বচ্ছ ভাইয়া আমার হয়ে টিচারদেরকে অ্যাপ্রোচ করেছিলেন আমার রেকমেন্ডেশন লেটারগুলো লিখে দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয়বার অ্যাপ্লাই করার সময়ে ততদিনে শিক্ষকরা আমাকে চিনে গেছেন, তাই তখন আর কোনো সমস্যা হয়নি।

আর দুইবারই অ্যাসেগুলো লেখার ব্যাপারে আমাকে হেল্প করে দীপ্র ভাইয়া, আবরার, আজনিফ, মেলিতা আপু, নামিরা আপু আর রাজদ্বীপ।

অরিত্র : রিজেকশন-পরবর্তী হতাশাকে সামাল দিয়েছিলেন কীভাবে? ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা শুনতে চাই।

সাবাবা : Fall-22-এ আমার লাস্ট রিজেকশনটা আসে মার্চের ৩০ তারিখে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, ডিপ্রেশন, নিজে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকা– সব মিলিয়ে প্রি-টেস্টের ৫০% সিলেবাসও কমপ্লিট হয়নি আমার। তখন একজন মানুষের কাছে গিয়ে অ্যাট লিস্ট প্রি-টেস্টে পাশ করার মতো পড়া কমপ্লিট করার ব্যাপারে তার হেল্প চাই। বললাম, এইচএসসির আগে সিলেবাস কমপ্লিট করে ফেলব। আমাকে বলা হলো, “তুই টেস্টে পাশ করবি তো?”

আমার ক্যাপাবিলিটির উপর এভাবে প্রশ্ন করায় আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম।

এসময় আমার কলেজের বন্ধুরা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। এছাড়াও DPT এর কাজ গুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমি আর অ্যাপ্লাই করব না, বুয়েটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

এরপর, স্টকহোম জুনিয়ার ওয়াটারপ্রাইজে বাংলাদেশ-২০২২ এ  ফাইনালিস্ট হওয়া, নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ডিপি টিউটোরিয়ালসের ইম্প্রুভমেন্ট দেখার পর মনে হলো, I can do something again. আবার দীপ্র ভাইয়াও উৎসাহ দিচ্ছিল। তা-ছাড়া Bangladeshis Beyond Border ফেসবুক গ্রুপে ৩ বছর গ্যাপ ইয়ার নিয়ে আনিকা তাবাসসুম আপুর ১০০% স্কলারশিপ পাওয়ার গল্পসহ বেশ কয়েকজনের স্টোরি দেখে আরো উৎসাহ পাই। ধীরে ধীরে আবার এসএটির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি৷  মনে হলো, আরেকবার ট্রাই করে দেখি। পাশাপাশি বিভিন্ন কম্পিটিশন চালিয়ে গিয়েছি। ইয়ং টাইকুনস বিজনেস চ্যালেঞ্জে ওয়ার্ল্ডে টপ ১০০-র মধ্যে ছিলাম।

কলেজ অ্যাপ্লিকেশনের সেকেন্ড জার্নিতে দীপ্র ভাইয়ার পর আমাকে সবচেয়ে বেশি মোটিভেট করে আবরার। আবরার হাসিনের কথা বলছি। আরো দু’জন ফ্রেন্ড তৈরি হয়– ফারহান মাহবুব ভাইয়া আর তাসমিম কবির মাহিম। সব মিলিয়ে আবার অ্যাপ্লাই করি৷ এইচএসসি শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরে আর্লি ডিসিশন ওয়ানের প্রথম রিজেকশনটা আসে। ভাবলাম, আমার আর অ্যাপ্লাই করা উচিত হবে না। কিন্তু এই সময় আমার মা আর মামি আমাকে এপ্লাই করার জন্য অনেক জোর করতে থাকে।

অরিত্র : আর দীপ্র ভাইয়া?

সাবাবা : দীপ্র ভাইয়া আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছে। ডিসেম্বরের শেষদিকে ওনাকে বললাম, “ভাইয়া, আমার দ্বারা অ্যাসে লেখা হচ্ছে না। আমি আর অ্যাপ্লাই করব না।” ভাইয়া বলল, “তোকে অ্যাপ্লাই করতেই হবে।” এই কারণেই আমি আমার অ্যাপ্লিকেশনগুলো কমপ্লিট করি।

এর মধ্যে অ্যাক্সেপ্টেড অ্যাপ্লিক্যান্টদের তুলনায় ভালো প্রোফাইল নিয়েও গেটিসবার্গে ওয়েইটলিস্টেড হওয়ার পর অন্য সব অ্যাপ্লিকেশন উইথড্র করে নিতে চেয়েছিলাম। ইন্ডিয়ার ম্যাচে রিরাট কোহলির কামব্যাকের উদাহরণ দিয়ে আমাকে তখন মোটিভেট করেছিল দীপ্র ভাইয়া।

মনে আছে, ডিপি টিউটোরিয়ালসের মিটিং শেষে কানেক্টিকাট কলেজের ডিসিশনটা চেক করি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। দীপ্র ভাইকে স্ক্রিনশট পাঠালাম। ভাই কল ব্যাক করল। I was crying. আই রিমেম্বার, ভাই কত খুশি হয়েছিল।

এই তো। জার্নি শেষ।

অরিত্র : পুরো কাহিনিটা শোনার পর আমি বাকরুদ্ধ। কী বলব, বুঝতে পারছি না। এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সাবাবা আপু।

সাবাবা : তোমাকেও ধন্যবাদ, অরিত্র।

Related posts